প্রান্তরে পদাতিক

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার জীবনের অনেকটা সময় বজবজে কাটিয়েছিলেন, আসুন জানি তার ব্যাপারে কিছু

লিখেছেন রোজী সিং

1940 সাল। রবীন্দ্রনাথ জীবিত। সেই সময় তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ ” সানাই” ও “রোগসজ্জায়” প্রকাশিত হয়ে গেছে। নজরুল স্বমহিমায় বিরাজিত । বাংলা কবিতার উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ ,অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র প্রমুখরা আছেন দিগ্বিদিক।ঠিক সেই সময় স্কটিশ চার্চ কলেজে 21 বছর বয়সী অনার্সের ছাত্রের কবিতা নিয়ে পাতলা একটা বই বার হলো ” পদাতিক”! “কমরেড আজ নবযুগ আনবে না।’

সুভাষ মুখোপাধ্যায় বোধহয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেম বা প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করলেন না ।জীবনের টানে, আদর্শের সন্ধানে, প্রতিবাদে ও প্রেরণায় তাকে পাওয়া গেল সাহিত্য ও রাজনৈতিক জীবনে। কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছিলেন ভালোবাসার টানে । সমর সেন তাকে “মার্কসিজম” বইটি পড়তে দিয়েছিলেন । এই বইটি সুভাষকে পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করে তার গোটা জীবন নতুন খাতে বইয়ে দিয়েছিল। পার্টি তে থাকাকালীন নানা রকম কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। চটকল মজুরদের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ, জাহাজী শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি।1948 এ জেল । নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীসভা । জেলে হাঙ্গার স্ট্রাইক করলেন। জেলে সহযোদ্ধা শ্রমিকদের কাছ থেকে শুনতেন তাদের যাপন কথা । এখানে বসেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন চটকল শ্রমিকদের বঞ্চনা। জেল থেকে বেরিয়েই বজবজ 36 মোজাফফর হোসেন রোড । সঙ্গে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় রমাকৃষ্ণ মৈত্র এবং দিলীপ রায় চৌধুরী।

“ওপর ওপর বেঁচে থাকা নয় কোথাও বেশ একটু গভীরে ডুব দিতে হবে। রমাকৃষ্ণ মৈত্র, দিলীপ রায় , চৌধুরী গীতা আর আমি, চার বন্ধুতে মিলে একদিন উঠে বসলাম বজবজের বাসে নেমেছিলাম চরিয়ালে।” সালটা 1952 এপ্রিল-মে মাত্র 8 মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছে সংসার পাতলেন ব্যঞ্জনহেরিয়ার মাটির ঘরে।বার্লিন থেকে বজবজ । কবির স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন “বহুদিন বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছি। অভিজ্ঞতার জন্য মনের ছটফটানি মেটাতে বিয়ের ঠিক 8 মাস পরেই চলে গেলাম ব্যঞ্জনহেঁড়িয়া গ্রামে। মজুর এলাকায় শুধু মিটিং করে কিছুই শেখা যায় না। ওখানে থেকে মশা-মাছি আর এঁদো পুকুরে ভরা গ্রাম আর বাঙালি মানুষের সঙ্গে ওঠাবসার ভিত্তিতে জীবন টাকে খুঁজে পাবার একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়েছিলাম।কলকাতার অনেকে বলেছিলেন ও সব শখ দু’দিনেই মিটে যাবে । কিন্তু এইসব যে দুদিনে মেটেনি তা আমরা দেখেছি। কবি দম্পতি এখানকার চটকল শ্রমিকদের মধ্যে ছিলেন আত্মহারা। তাদের জীবন যুদ্ধে সর্বাগ্রে পাশে থাকা, সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না শরিক হয়ে সকলের ভালো থাকার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তারা (কবি দম্পতি) অনুভব করেছিলেন শিক্ষা-স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা পরিবারগুলিকে নতুন করে জীবন দেবে। তাই স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ, শিশু দিবস পালন, বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কাজ বজবজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জোয়ার এনেছিল।”সালেমনের মা”, “সুন্দর”, “একটি লড়াকু সংসার” এই কবিতাগুলো তারই সাক্ষী । আড়াই বছর তারা এখানে ছিলেন। বজ বজ থেকে চলে যাবার পরও কিন্তু ভুলে যাননি। এখানকার কথা, যাপনের স্মৃতি বারংবার ধরা পড়েছে তাদের লেখনীতে। “সন্দেশ” পুনঃপ্রকাশ হবার পর গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়মিত লিখতেন।তার একটি ধারাবাহিক ” পিকলুর সেই ছোটকা” বজবজের কথা মনে করিয়ে দেয়। জুটমিল ধারের খাটাল, পাঞ্জাবি কন্ডাক্টর 77 নম্বর বাসের দরজার ঝুলে লোককে বলে ‘ঝাঁকিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন’ ।একটা হাত তার এমন খোলা যেন সে উড়ে যাবে। “কি এক গভীর চিন্তায় কপাল কুচকে আছে চড়িয়াল এর রাস্তা” চড়িয়াল এ রাস্তা দেখি কবি সুভাষ এর এমনটাই মনে হয়েছিল । তিনি মনে করতেন তাঁর কাব্য চেতনার উত্তরন ভূমি এই বজ বজ। “একটানা 12 বছর ফনিমনসা হয়ে কাটিয়েছি ।স্বেচ্ছায় কবিতার হাতে ধরা দিইনি। বজ বজে এসে ফুটেছে ক্যাকটাসের ফুল” ‘বজবজ এর মজুরদের মধ্যে থেকে কতগুলো ব্যাপারে আমায় সত্যিই চোখ ফুটেছে। শ্রমজীবী মানুষের দুটো জীবন- কর্ম জীবন এক রকম, পরিবারে আরেকরকম।’ আমাদের প্রশ্ন তিনি বজ বজ কে কেন নির্বাচন করলেন? শ্রমজীবী মানুষের টানে তিনি ছুটে গেছেন বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। মিশে গেছেন তাদের ভিড়ে। তিনি বলেছিলেন “বজ বজে আমাদের চেনা মানুষ ছিলেন।” কে সেই চেনা মানুষ? সেই সময়ে বজ বজে কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বে ছিলেন সন্তোষ ঘোষ। তিনি 1948 থেকে 1959 এতগুলি বছর বজ বজে ছিলেন। এনারা একইসঙ্গে লেবার পার্টি করতেন এবং একইসাথে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন ।এখানে ওই সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, কারণ সেই সময় সন্তোষ বাবুর নেতৃত্বে এক শক্তিশালী সংগঠন গড়ে ওঠে যার ফলস্বরূপ 1952 ও ’57 এর নির্বাচনে বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় বজ বজ থেকে নির্বাচিত হন।এই সময়ে শ্রমিকশ্রেণী ছিল কমিউনিস্ট পার্টির মূল অংশ। 

“ওপর ওপর বেঁচে থাকা নয় কোথাও বেশ একটু গভীরে ডুব দিতে হবে।”

শিক্ষিত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী তখনও এই পার্টিতে যোগ দিতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। 1952 সালে বঙ্কিমবাবু প্রার্থী হওয়ায় শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত মানুষ কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে এগিয়ে আসেন। সুতরাং সন্তোষ ঘোষের এই আদর্শবাদ কে সমর্থন জানাতে কবি দম্পতি ছিলেন পুরোধা ব্যক্তি। অজয় ঘোষ, যোশী ডাঙ্গের ন্যাশনাল ফন্ট আর রণদীভের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের তাত্ত্বিক বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন সুভাষ বজবজে।বজবজের আড়াই বছরের বাস তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও কবিতার ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। শ্রমিক বস্তিতে থেকে তিনি কেবল বিপ্লব সাধন করেন নি, সব কটি মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়েছিলেন। বামাচরণ সানি, সাজ্জাদ আলি, হারান দলুইরা ছিলেন নবযুগের প্রবর্তক।পুঁথিগত বিদ্যা তাদের ছিল না। সুভাষ অনুভব করেছিলেন এদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে শ্রমশক্তির গুরুত্ব এবং শ্রেণিচেতনাবোধ গড়ে তোলার জন্য প্রাঞ্জল ভাষায় লেখেন ‘ভূতের বেগার’। মুসলমান গ্রামবাসীদের সাহচর্য তাকে অপার আনন্দ দিত।মাছ ধরতে ভালোবাসতেন আর অসম্ভব ভালোবাসতেন শিশু সঙ্গ । শ্রমিকদের সাথে মিশে মিছিল-মিটিং ডেপুটেশন গেট মিটিং দিয়েছিল তার স্বপ্ন সাজানোর দিন।

নিরক্ষর গ্রামবাসীদের নিয়ে শহীদ প্রতিভা পাঠশালা, আন্তর্জাতিক শিশু দিবস উদযাপন এসব ছিল ‘ফিরে চল মাটির টানে’ অভিযান। 1954 সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ওনারা এখানে ছিলেন। তারপর চলে যান কলকাতায়। কিন্তু বারবার এসেছেন মানুষগুলোর টানে। এখানে থাকা কালীন যেসব কবিতাগুলো তিনি লিখেছিলেন তার মধ্যে অনেকগুলো স্থান পেয়েছে তার অন্যতম কাব্যগ্রন্থ “যত দুরে যাই” (প্রকাশ 1962) তে এছাড়া বজ বজ কে ভেবে লেখা অনেকগুলি কবিতা প্রকাশ হয়েছে তার “ফুল ফুটুক” (1957 )কাব্যগ্রন্থে। তারপর কেটে গেছে অনেক গুলো দিন, বছর,মাস বজবজের গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। স্তব্ধ হয়েছে অনেক জুটমিলের সাইরেন। রাজনৈতিক পটভূমিতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। যখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়া শুরু করি তখন তেমন ভাবে কিছু বুঝিনি। তাকে প্রথম পাওয়া পাঠ্যবইতে। তারপর কবিকে চিনি তার কবিতা দিয়ে। ধীরে ধীরে জানতে থাকি তার রাজনৈতিক জীবনের নানা ওঠাপড়া, হার না মানা ঝাঁকড়াচুলো দৃপ্তরুপী কবির নিজের কাছে অকপট থাকা আকর্ষণ করতো তার লেখার মতোই। শতবর্ষের কবি আজও বর্তমান এবং প্রাসঙ্গিক। তার লেখনী ও জীবন কথা এই প্রজন্মের কাছে সমান জনপ্রিয় বজ বজ এর প্রতিটি মানুষের মনে যে তিনি অম্লান তার প্রমাণ মিলল আরও একবার 36/1 (পূর্বের 36)মোজাফফর হোসেন খান রোড, আহমেদ সাহেবের বাড়ি।এটি ছিল সেই পীঠস্থান, স্মৃতিমেদুর কন্ঠে আবেগ বিহ্বল আহমেদ আলি শোনালেন, সুভাষ কাকা ও গীতা পিসির কথা তাদের বাড়িতে কেবল বসবাস করতেন তা নয়, তাদের পরিবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন কবি দম্পতি। আহমেদ সাহেবের মা কবিরণের কথা আছে কবির ‘পায়ে পায়ে’ কবিতায়- ‘আহমদের মা’।আবার কবি রনের মেয়ে গোলবানুরের কথা আছে ‘আবার ডাকবাংলো’ বইতে। ব্যঞ্জনহেরিয়ার ধূলিতে মিশে আছে ব্যক্তি সুভাষ, কবি সুভাষ, রাজনীতিক সুভাষের অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন পদাতিক, প্রান্তরই তাঁর চারণভূমি এবং বহমানতাই ছিল তাঁর আদর্শ। নিস্তব্ধ এক হৈমন্তী সন্ধ্যায় ব্যঞ্জনহেরিয়ায় সেই বাড়িটা থেকে ফিরে আসছিলাম। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে প্রাচীন জনপদ, তার ছায়া পড়েছে পুকুরের জলে।মনে পড়ল— ” তারপর যে-তে যে-তে যে-তে এক নদীর সাথে দেখা পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা পরনে উড়ু উড়ু ঢেউয়ের নীল ঘাঘরা তারপর যে-তে যে-তে যে-তে…..

error: No No No!! Cannot right click