তোমার আসন শূন্য আজি....

বর্ষা শেষ এক মন্থর সন্ধ্যায় বজবজের  সাথে আমার প্রথম পরিচয়। দূর থেকে ভেসে আসা ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ সেই মেদুর সন্ধ্যাকে ইপ্সিত করে তুলেছিল। সে এক ভীষণ ভালো লাগা।আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকা সেদিনের সেই বৃষ্টিভেজা স্থবির বজবজ এক নিমেষে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছিল অন্তরমহলে। ক্রমে যত তাকে চিনেছি ভালোবেসেছি নিবিড় ভাবে, জড়িয়ে ধরেছি তার ইতিহাসকে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি বজবজের আনাচ-কানাচ। অনেক ভালো লাগার মধ্যে “কুইন” সিনেমার বিপরীতে একটি ভগ্নপ্রায় ইমারত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো বারবার। তখনো জানিনা পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ভগ্নপ্রায় ইমারতটি ইতিহাসের কি সাক্ষ্য বহন করছে।
 
 
১৯২৮ সাল। বজ বজে গড়ে ওঠে ‘বেঙ্গল অয়েল এন্ড পেট্রোল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’নামের একটি সংগঠন।সেটি গড়ে তোলার মূল উদ্যোগী ছিলেন এক অগ্নিপুরুষ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি নিজে ছিলেন এই সংগঠনের সভাপতি। উনার এই বাড়িটি ছিল ইউনিয়নের অফিসঘর। সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসুর ছাড়া সম্পাদক ছিলেন শ্রী সুধীর কুমার প্রামানিক। কোষাধ্যক্ষের ভাবছিল রামচন্দ্র আয়স্থি বা মান্নাবাবুর উপর। স্থানীয় রেকর্ড থেকে জানা যায় ১৯২৮ সালে প্রথমবার নেতাজি এখানে আসেন, এম. এল. দাঁ রোডে মান্নাবাবুর চালকলের মাঠে এক শ্রমিক জনসভায় যোগ দিতে। জন্মসূত্রে উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা হলেও মান্নাবাবু আজীবন বাস করেছেন বজবজে। নেতাজির সঙ্গে তাঁর সখ্যতা ও অন্তরঙ্গতা ছিল গভীর।বলা যায় বজবজ এর সঙ্গে নেতাজির যোগাযোগের মূল উপলক্ষ ছিল শ্রমিক আন্দোলন এবং যোগাযোগের মূল সেতু ছিলেন  মান্না বাবু।
 
 

১৯২৯ সাল। পেট্রোলশিল্পে আড়াই মাস ব্যাপী এক ঐতিহাসিক ধর্মঘট পালিত হয়। এই আন্দোলনের দীপশিখাটি তেল শ্রমিকদের মধ্যে অনির্বাণ করে দিয়েছিলেন নেতাজি। কুইন সিনেমার বিপরীতের এই বাড়িটিতে গোপনে সভা হতে থাকে। প্রায়ই থেকে যেতে নেতাজি। গোপনে রাত্রিবাস চলত এ বাড়িতে।ব্যায়ামবীর শ্রী বসন্ত সামন্ত যিনি তখন পি.কে স্কুলের তৎকালীন ব্যায়ামের শিক্ষক, তিনি নেতাজির পাহারায় থাকতেন। বজবজের সঙ্গে নেতাজির ঘনিষ্ঠতা তখন খুবই গভীর হয়েছিল।বলার কথা, কোমাগাতামারু ঘটনার নেতা বাবা গুরুদিৎ সিং নেতাজির সঙ্গে এই আন্দোলনে শরিক হন। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মান্নাবাবুর বাড়িতেও নেতাজি থাকতেন বলে জানা যায়।স্থানীয় রেকর্ড থেকে এরকম কিছু কথা জানা যায় কিন্তু মোট কতবার নেতাজি বজবজে এসেছিলেন বা কতগুলি সভা করেছিলেন, সেগুলি সম্ভবত কোথাও লেখা নেই। “সুভাষ রচনাবলী”তে কয়েকটি জনসভার কথা সংক্ষিপ্তভাবে বলা আছে। সেইসব জনসভায় নেতাজির বক্তৃতার কিছুকিছু অংশ লেখা আছে।

কুইন সিনেমার বিপরীতের এই বাড়িটিতে নেতাজি আসতেন

১৯৪০ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি। লিখিতভাবে শেষবার নেতাজির মিটিং এই বজবজে। তৎকালীন ‘স্টার গ্রাউন্ড’ যা এখন ‘সুভাষ উদ্যান’ বলে পরিচিত। এখানে তিনি ঘন্টা দুই বাংলা ও হিন্দিতে বক্তব্য রাখেন। ঐদিন বজবজে পাবলিক লাইব্রেরীর পক্ষ থেকে তাঁকে এক অভিনন্দন পত্র দেওয়া হয়।এর কিছুদিন পর অর্থাৎ হাজার ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসের এক শীতের রাতে এলগিন রোড এর বাড়ি থেকে গোপনে ও ছদ্মবেশে ঘটে তাঁর মহানিষ্ক্রমণ যা আজও রহস্য।
 
প্রকৃতির নিয়মে ঋতু পরিবর্তন হতে থাকে। পরিবর্তন হয় সময়ের। সংরক্ষণের অভাবে এই বাড়িটি ক্রমে শীর্ণকায় চেহারা নেয়।অগ্নিযুগের ইতিহাস ভগ্নস্তূপে পরিণত হতে থাকে। এই ইমারতের প্রতিটি কোনায় আছে নেতাজির যাপন চিহ্ন। এখানে জন্ম নিয়েছে কত শ্রমিক বিপ্লবের কাহিনী, কিন্তু “সুভাষ ঘরে ফেরে নাই”! বিপ্লব, অনশন, নির্জনবাস, ছদ্মবেশে পলায়ন – এসবকিছু ও ব্রিটিশ চক্রবুহ্য ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে সুভাষ একদিন ঘরে ফিরবে এই আশা ছিল আপামর ভারতবাসীর।হয়তো আজও সেই অপেক্ষায় আছে এই ভগ্নপ্রায় ইমারতটি ।অপেক্ষায় আমরাও —

"তোমার আসন শূন্য আজি

হে বীর পূর্ণ করো"

লিখেছেন রোজী সিং

এডিটিং শহিদুল ইসলাম এবং আমাদের বজবজের তরফ থেকে শ্রীমান রঞ্জন পরামাণিক কে ধন্যবাদ তার অতি মূল্যবান তথ্যের জন্য ..

error: No No No!! Cannot right click