হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে...

চিরকালের চেনা কোন মানুষকে জানার বা চেনার অবকাশ আমরা সারা জীবন ধরে পাইনা।তাঁকে চেনা জানার মধ্যেকার ব্যবধান টুকু ঘোচেনা কোনোকালেই। কখনো কখনো মনের কোণে, অন্তরে-বাহিরে তিনি চিনেও অচেনা, জেনেও অজানা থেকে যান। ঠিক চিনেছি মনে করলেও, কিন্তু সেটা পরিচয় থেকে যায় সম্পূর্ণ জানা হয়ে ওঠে না ।চিরকালের সেই চেনা কবি কাজী নজরুল এমন একজন যাঁর সাথে পরিচয় সেই কোন ছেলেবেলায়। তাঁর কাছে “খুকি” হয়ে থাকায় ছিল সবচেয়ে সহজ। কঠিন হলো তাঁকে খুঁজতে যাওয়া তাঁর মধ্যে। কারণ, বাঙালির মধ্যে কাব্য বা সাহিত্যে তিনি এক অন্যতম বর্ণময় স্রষ্টা।সৃষ্টির বৈচিত্রে, দুর্দমনীয় প্রাবল্যে ও অন্তিমে বাঁধনহারা নীরবতায় তিনি নিজেই যেন এক বিকীর্ণ ইতিহাস। বাঙালির জীবনে অবিভাজ্য নক্ষত্র, ভাগ না হওয়া নজরুল সমগ্র দেশবাসীর কাছে একান্ত কাছের মানুষ।

 এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হেঁটে চলেছি কয়লা সড়কের রাস্তা ধরে বজবজ মিলের পুরনো গেটের দিকে।শেষ বিকালের পড়ে আসা আলোয় চারিদিক একটু কেমন বিষন্ন, দূরে কোথাও কোথাও আলো জ্বলে ওঠার প্রস্তুতি।অনেক মহামানবের উপস্থিতিতে আলো হয়েছে আমাদের বজবজ। এখানে বটু পালের বাড়ির ঠিকানায় কবি নজরুলকে কিছুদিনের জন্য পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম আমরা। যোগসুত্র ছিলেন কবি নজরুলের এক পালিতা কন্যা শান্তিলতা দেবী। কবি নাম দিয়েছিলেন “খুকি”। শান্তিলতা আসলে ছিলেন কবিপত্নী প্রমীলা দেবীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়া। মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে বালিকা শান্তিলতা সর্বপ্রথম কবির বাড়ি বেড়াতে আসেন। সময়টা ছিল ১৯২৮ সালের প্রথমার্ধ, কবি পুত্র বুলবুলের বয়স তখন আড়াই বছর। পিতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতায় মা সুশীলা দেবীকে কবি অনুরোধ করেন কন্যাটিকে রেখে যাবার জন্য। শোনা যায় নজরুল-প্রমীলার একটি কন্যা সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। তার কথা ভেবেই হয়তো কবি শান্তিলতাকে খুকি হিসেবে সংসারে পেতে চেয়েছিলেন
 
শান্তিলতার পিতা নিবারণ সেনগুপ্ত, মাতা সুশীলা দেবী ও দাদা বিজয় সেনগুপ্ত(খোকা) কবি পরিবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।সুশীলা দেবী বজবজের একটি প্রাইমারি স্কুলে (জয়চন্ডীপুর, পরে সুভাষ উদ্যান )শিক্ষকতা করতেন।কবি অসুস্থ হওয়ার সময় থেকে খোকা ও খুকি দুজনেই নজরুলের পরিবারে এসে বসবাস করেন এবং কাজকর্মের ব্যাপারে নানাভাবে সহযোগিতা করেন।কবির  অসুস্থতার অনেক পরে শান্তিলতা মায়ের স্কুলে চাকরি নেন সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করার পরেও প্রয়োজনীয় কম শিক্ষাগত যোগ্যতার অজুহাতে তিনি বজবজের সেই স্কুলের চাকরি থেকে উৎখাত হন। এ ব্যাপারে মামলা মোকদ্দমা করেও কিন্তু তিনি চাকরি ফিরে পাননি। বজবজের কয়লা সড়কে ছিল তাঁর বাড়ি (ডেন্টিস্ট মৃণাল সেনের বাড়ির পাশে)। পরে অবশ্য শ্যামপুকুর রোডে মিত্রদের বাড়িতে ভাড়া উঠে যান।কবি যখন ৫০/২ A মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে থাকেন , শান্তি লতার মা  খুকিকে নিয়ে চলে আসেন বিয়ে দেবার জন্য পাত্র । বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত ।সেই সময় তিনি ঘরজামাই ছিলেন। বিয়ের পরেও কবির সংসারে খুকির নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তিনি কবি পরিবারে এসে থাকতেন এবং অসুস্থ কবির দেখাশোনা করতেন ।বিদেশে চিকিৎসার জন্য কবিকে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেই কাজ অব্যাহত ছিল।
 

কাজী নজরুল কিন্তু বেশ কয়েকবার বজবজে আসেন। প্রথম ১৯২৫ সালে শ্রমিক আন্দোলনের সভাতে। সে বছর ‘লাঙল ‘ অর্থাৎ শ্রমিক আন্দোলনের মুখপত্র প্রকাশিত হয়। সঙ্গে থাকতেন ঠাকুরবাড়ির সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শ্রমিক সভায় কবি গান গাইতেন , আবৃত্তি করতেন।১৯২৮ সালে বজবজের এরকমই একটি শ্রমিক সবাই কবি “ফরিয়াদ” কবিতাটি আবৃত্তি করেন।এই সভাতেই “ওড়াও ওড়াও লাল নিশান”(রক্ত পতাকার গান) ও” জাগো অনশন বন্দী” (দ্য ইন্টারন্যাশনাল) গেয়েছিলেন।১৯৪১ সালে বিশ্বকবির প্রয়ানের পর বজবজের টাউনহলের স্মরণসভায় কবি “রবিহারা” কবিতাটি আবৃত্তি করেন।

জীবিত অবস্থায় ধর্মান্ধরা নানাভাবে কবির বিরুদ্ধাচারণ করেছেন।অসংখ্যবার কষ্টের কাঁটা বিঁধেছে তাঁর পায়ে, রক্তাক্ত হয়েছে দেহ, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে হৃদয়, ঋণ শোধ না করতে পারা, মামলা, স্ত্রীর অসুস্থতা, গ্রন্থের রয়্যালটি বন্ধক রাখা ইত্যাদি নানা অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা কবি ও তাঁর পরিবারকে ঘিরে ফেলেছিল। অপ্রতিরোধ্য আবেগ ছিল কবির স্বভাবে ও চলনে।কিন্তু এইসব দুর্যোগ প্রাণবন্ত এই মানুষটির জীবনে এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। অসংখ্যবার বাসস্থান বদলও নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে থাকা যেন কোন অভিশাপ বহন করে চলছিল। অসুস্থ সস্ত্রীক কবি তখন ভবঘুরে ।সত্যি যেন “পথহারা পাখি”।

 ১৯৫৩-৫৪ সাল । কবির ঘোরতর দুর্দিন।প্রমীলাদেবীর আত্মীয়রা ঠিক করলেন, সকলের বাড়িতে দু এক মাস করে কবি ও তাঁর পরিবারকে রাখবেন যতদিন না স্থিতিশীল কোন ব্যবস্থা সরকারি আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায়। শান্তিলতা দেবী কবির “খুকি” নিয়ে আসেন কবি পরিবারকে বজ বজ কয়লা সড়কের এই বাড়িতে। ছোট্ট দু কামরার ঘর, একটি বারান্দা। একটি ঘরে একটি চৌকিতে কবি ও কবিপত্নী থাকেন।চৌকির মাঝখানটা জায়গা করে খাবার-দাবার দেওয়া হয়। কবি নাতনির কথা অনুযায়ী-প্রথমদিকে কবির আগমন সংবাদ অনেকে জানতেন না।জগদীশ ব্যানার্জি মহাশয়ের দুই মেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে খবর পেয়ে বাড়িতে গিয়ে বলে। কৌতুহলী জগদীশবাবু এসে যখন দেখেন কবি এসেছেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘরদোর সারাবার উদ্যোগ নিলেন এবং আলোর ব্যবস্থা করে দিলেন।অনেক মানুষ আসতেন, কিন্তু কবি নির্বাক, নীরব, ভাষাহীন, স্তব্ধ, বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন। কখনো কখনো বিরক্ত হতেন। কেউ গান গাইলে হাততালি দিতেন। হাতে কাগজ পেলে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলতেন। ছোটদের সঙ্গ বুঝি ভালো লাগত। কেউ প্রণাম করলে মাথায় হাত দিতেন। খুব বেশি সময় এখানে ছিলেন না। এক মাস পর আবার বাসা বদল। চলে গেলেন উত্তর কলকাতার বাদুর বাগান বাজারের পাশে আর এক আত্মীয় ডক্টর নিপেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের বাড়ি।
 
খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও বজবজবাসী ধন্য হয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যখন দেখি ওই বাড়িটির কোন অস্তিত্ব আজ আর নেই। হয়নি কোন সংরক্ষণ। কালের নিয়মে শূন্যস্থান পূরণ হয়।তাই সেখানেও এসেছে নতুন মানুষজন, নতুন বাসস্থান, নতুন লোকালয়, রয়ে গেল একটি মহাজীবনের মহাকাব্যের অন্তিম কণামাত্র।
 
কবি-চিকিৎসকের কথায় “বাংলার  প্রদীপ আজ নির্বাণ মুখে। প্রতিভার দীপরশ্মি নিভিয়া গিয়াছে।কেবল অসাড় অনড় দেহ মলিন শয্যায় পড়িয়া আছে ।জীবন আছে গতি নাই, আকাশ আছে পূর্ণচন্দ্র নাই, তারাও নাই ।কবির কণ্ঠ সরব কিন্তু সেই ভাষা মানবের জন্য নয় ।বিড় বিড় করিয়া কহিতেছেন কিছুই বুঝলাম না(ডাক্তার মোহাম্মদ হোসেন)।
অনেকক্ষণ বৃথা দাঁড়িয়ে রইলাম এবার আসার ফেরার পালা। মনের মধ্যে অনুরণন—
“এলে অবেলায় পথিক বেভুল,
বিঁধিছে কাঁটা নাহি পাবে ফুল,  
কি দিয়ে বরণ করি ও চরণ,
নিভেছে জীবন জীবনস্বামী,
 
শান্ত বিশ্ব চরাচরে তখন রাত নেমেছে”
কি দিয়ে বরন করি ও চরন,
ঋণ স্বীকার :
ডক্টর বাঁধন সেনগুপ্ত (নজরুল গবেষক )
শ্রী মতি মালবিকা দত্ত (কবি নাতনি) 

লিখেছেন রোজী সিং

এবং এডিটিং শহিদুল ইসলাম

error: No No No!! Cannot right click