Komagata Maru

কোমাগাতা মারু বজবজ—আর একটি জালিয়ানওয়ালাবাগ

লিখেছেন রোজী সিং

আদিগন্ত বিস্তৃত অনন্ত জলরাশির মধ্যে এক অলৌকিক জলযান- জাহাজ যার মন কেমন করা ডাক বারবার আমাকে মুগ্ধ করে। ভালো লাগার এই প্রাচীন জনপদকে আরো ভালো লাগার কারণ এই জলযানটি। কালী বাড়ির সামনের ঘাটে মাঝে মাঝে বিরাট আকারের জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকে জলে।সন্ধ্যাবেলা মন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি আর দূরে জাহাজের বিন্দু বিন্দু দোদ্যুলমান আলো যেন এক অপার্থিব, এক নাম না জানা অধ্যায়। অনতিদূরে অপেক্ষমান ইতিহাস-কোমাগাতামারু বজ বজ, একটি তীর্থক্ষেত্র। কোমাগাতামারুর কাহিনী বজ বজে ঘটে যাওয়া একটি নিছক দাঙ্গা বা হত্যাকান্ড নয়।এই ঘটনা দেশবাসীকে দেখিয়েছিল পরাধীনতার লাঞ্ছনা সহ্য করে এদেশের সাধারন মানুষ দলবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার হিম্মত রাখে। ইঙ্গ-শিখ এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেন মহাযুদ্ধের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল।
 
বিষন্ন শীতের দুপুরে বা হৈমন্তী বিকালে বজ বজ এর পুরানো রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে একা বা দলবেঁধে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় চার নম্বর গেট। পায়ের নিচে বোবা পথ একদল জাতীয়তাবাদী মানুষের সংগ্রামের সাক্ষী।শুকনো পাতা আর একরাশ নির্জনতা কথা বলে একটি জাহাজের আর শিখ সম্প্রদায়ের দেশপ্রেমের।
 
সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সাল। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ ব্রিটিশ শাসনাধীন। ভারতীয় বংশোদ্ভুত কানাডার নিবাসী এক ঠিকাদার ছিলেন বাবা গুরদিৎ সিংহ(১৮৫৯-১৯৫৪)। তিনি সিঙ্গাপুরে কন্ট্রাক্টরি করতে ন। ব্যবসার কাজে তিনি নানান দেশে যেতেন এবং ব্রিটিশ শাসিত এলাকায় ভারতীয় শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত।তিনি ভাবছিলেন কিছু স্বজাতিকে যদি ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় নিয়ে তাদের রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। একবার তিনি ভারতবর্ষে এসে কিছুদিন কাটিয়ে যান। পরের বছর যান হংকং। এখানকার দেড়শ শেখ কানাডায় যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো কানাডা ইমিগ্রেশন আইন। তাই তিনি এই পথ অবলম্বন না করে হংকংয়ের একটি জার্মান শিপিং এজেন্টের মাধ্যমে একটি জাহাজ ভাড়া করেন যার নাম ছিল এস.এস. কোমাগাতামারু।এস.এস.কোমাগাতামারু কেবল একটি জাহাজে নয়, পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে শিখ সম্প্রদায়ের জীবন যুদ্ধের জ্বলন্ত ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে বজ বজ।এই সংগ্রামকে মনে রেখে এবং ঘটনার ১০০ বছর অতিক্রান্ত সময় কে সম্মান জানিয়ে বজ বজ রেল স্টেশন এর নতুন নাম হয় কোমাগাতামারু বজ বজ।
 
 

“এরপর একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে বন্দর থেকে কোমাগাতামারু কে বিতাড়িত করে জয়ের হাসি হাসল কানাডা গভর্মেন্ট।”

১৯১৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল। হংকং থেকে ১৬৫ জন যাত্রী এবং পথে বিভিন্ন স্থান থেকে আরও ২১১ জন যাত্রীকে নিয়ে (মোট ৩৭৬ জন) কোমাগাতা মারু রওনা দেয় কানাডার উদ্দেশ্যে। যাত্রীদের মধ্যে শিখছিলেন ৩৫১ জন এবং পাঞ্জাবি মুসলমান ছিলেন ২৫ জন। ২৩ শে মে ১৯১৪ তে জাহাজ ভ্যানকুভার বন্দরে গিয়ে পৌঁছালো কিন্তু কানাডার আইন ভঙ্গ করার অভিযোগে ইমিগ্রেশন অফিসাররা যাত্রীদের নামতে দিল না। ভ্যানকুভার এ ভারতীয়রা তাদের সাথে দেখা করতে চাইলেও তা অগ্রাহ্য হলো। চারিদিকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু কানাডা গভমেন্ট সবকিছু অগ্রাহ্য করে চলল। এরকম বন্দীদশায় দুমাস জাহাজ বন্দরে অপেক্ষা করে রইলো। তখনও যাত্রীরা জানেনা কি আছে তাদের ভাগ্যে।অবশেষে সশস্ত্র পুলিশ মন্ত্রী দুটি লঞ্চ পাঠালো কানাডা গভর্মেন্ট কোমাগাতামারুকে বন্দর থেকে উৎখাত করতে কিন্তু তারা ব্যর্থ হলো।এরপর একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে বন্দর থেকে কোমাগাতামারু কে বিতাড়িত করে জয়ের হাসি হাসল কানাডা গভর্মেন্ট।

Naveen Girn talking about Komagata Maru

শ্রান্ত, ক্লান্ত, অভুক্ত যাত্রীদের নিয়ে ১৯১৪ সালের 26 শে সেপ্টেম্বর কোমাগাতামারু নোঙ্গর করল বজ বজে।আগে থাকতে ঠিক করা ছিল এই যাত্রীদের কলকাতা বা অন্য কোন জায়গায় ছেড়ে না দিয়ে সোজা পাঞ্জাব নিয়ে যাওয়া হবে বজ বজ রেল স্টেশন দিয়ে। কিন্তু বাবা গুরদিৎ সিং এই প্রস্তাবে অসম্মত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর দলবল সহ নামলেন সঙ্গে আছে গ্রন্থসাহেব। রেললাইনের ক্রসিং অব্দি এসে তাঁর মনে হয়েছিল খারাপ কিছু করতে পারে। হয়তোবা আসামে নিয়ে গিয়ে তাদের অন্তরীণ করে রাখা হবে বা অন্য কিছু।এতদিনের বন্দিদশা আর অজানা উদ্বেগে হঠাৎ কিছু শিখ দলবদ্ধ ভাবে বজ বজের রাস্তা ধরে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে দিল। সঙ্গে গ্রন্থসাহেব। তাঁরা যেভাবেই হোক আগে হাওড়া পৌঁছাবেন। সেখানকার গুরুদুয়ারা গ্রন্থসাহেব জমা রাখবেন তারপর অন্য কথা।কিন্তু খবর পেয়ে সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার ইস্ট উডের অধীনে লাঠিধারী পুলিশ বাহিনী এসে পৌছালো এবং আলোচনার শর্তে গুরদিৎ সিংহ রাজি হলেন। সব শিখ ফিরে স্টেশনের পেছন দিকে সবুজ ঘাসে ঢাকা একটুকরো জমিতে গ্রন্থসাহেব নিয়ে বসল। এখানে গুরদীত সিংহ কে আলোচনার জন্য একা ডাকা হলে তিনি দল ছেড়ে যেতে নারাজ হলেন। সকলে ভাবল হয়তো বা গুরুদিৎ সিংহ কে গ্রেফতার করা হবে। শিখ রা একজোট হয়ে উঠে দাঁড়ালো। মিঃ ইষ্ট উড এর মধ্যে জবরদস্তি বাবা গুরুদিৎ সিং এর কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করলেন। চলল গুলি,পরিস্থিতি পরিণত হল দাঙ্গা এবং লড়াইতে। সৈন্যদের গুলির দাপটে ওই দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।অনেক শিখ পালিয়ে যায় এবং তাদের দুর্গতির শেষ ছিল না।সেই সময়কার কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা যেমন বেসরকারি ইংরেজি দৈনিক পত্র ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ লিখেছে, “১২টি মৃতদেহ পরপর পড়ে আছে তাদের দেহের দিকে চাইলে বোঝা যায় কি নিষ্ঠুর যুদ্ধই না তারা করেছে। কয়েকজনের দেহ গুলির দ্বারা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। কারো কারো দেহ সমস্ত বেয়োনেটের আঘাতে ছিদ্র হয়েছে। একজনের পেট ছড়া বা তরবারির আঘাতে প্রায় দু আধখানা হয়ে গেছে। সব থেকে হিংস্র লড়াই হয় লেভেল ক্রসিংয়ের দক্ষিণ দিকে ও স্টেশনের প্লাটফর্মের উপর।ওই লড়াইয়ের শেষ চিহ্নরূপে’ দেখা যায় মাটির উপর জমা কিছু কিছু রক্তের ছাপ এবং কাছের দুটি গুমটির রক্তমাখা দেয়াল। ওই গুমটি দুটিতে কয়েকজন শিখ আশ্রয় নিয়েছিল এবং এখানেই তারা নিহত হয়। সংঘর্ষ চলে সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান পালনকারীরা কেউ কেউ দক্ষিণাভিমুখে এক মাইলের মধ্যে যেসব গ্রামবাসীর বাস তারা জানায়, পলাতক শিখেরা অত্যন্ত ভয়ে কাতর ক্ষুধা ও আচ্ছাদন হীনতায়  পাগলের মত হয়ে যায়। তাদের কোন জোর জবর্দস্তি ছিল না ছিল খালি অনুরোধ খাদ্য ও পরিধানের।”
 
ইংরেজদের পক্ষে নিহত হন ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট মি: লোমেস্ক ও সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার ইস্ট উড। আহত ৫ অফিসার। এরা ছাড়া পাঞ্জাব পুলিশের চারজন ও বেশকিছু সংখ্যক কনস্টেবল আহত হন। কোমাগাতামারু যাত্রীদের মধ্যে আহতের সংখ্যা জানা যায় না। গুরু জিৎ সিংহ সহ ২১ শিখ জন পলাতক হন।
 

Canadian PM Justin Trudeau apologizes for 1914 Komagata Maru Incident

সবুজ ঘাসে ঢাকা রক্তাক্ত জমিটি আজ একটি শহীদ স্তম্ভ বহন করে যেটি নির্মাণের পর উদ্বোধন করেন প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহর লাল নেহেরু.এই স্মৃতিমঞ্চে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে গেছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ঞ্জানি জৈল সিং,পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী গন,লোক সভার ডেপুটি স্পীকার প্রমুখ বিশিষ্ট শিখ নেতৃবৃন্দ।১৯১৬সালে আমেরিকা ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথঠাকুর কানাডায় যাবার নিমন্ত্রন পেয়েছিলেন।কিন্তু কোমাগাতামারু যাত্রীদের প্রতি কানাডা সরকারের বৈষম্য মূলক আচরনের প্রতিবাদে তিনি এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।
 
সময়ের সমুদ্রে সবকিছু মিশে যায় একদিন কিন্তু ইতিহাস ফিসফিস করে কথা বলে। বজবজের মাটিতে প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল নবাব সৈন্য ও ইংরেজদের মধ্যে দ্বিতীয় যুদ্ধ হলো শিখ ও ইংরেজদের মধ্যে। আজ ভারত বর্ষ স্বাধীন। আর তার স্বাধীনতার শরিক কমাগত মারু বজ বজ। ওই সংগ্রাম ক্ষেত্র আজ তীর্থস্থান। প্রচুর শিখ আসেন এই তীর্থস্থানে।আসেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান এই শহীদ বেদীতে।এই পুরাতন রেল স্টেশন স্বামীজীর পদস্পর্শে ধন্য, ধন্য শত জাতীয়তাবাদীর রক্তের । বজবজের ইতিহাসে এই অধ্যায় আজও অমলিন ও গৌরবের।
error: No No No!! Cannot right click