Budge Budge Kali Bari
কালী বাড়ি
বজ বজ কালীবাড়ি বলতে আমরা জানি বিকেলের আড্ডা , ফুচকা , অসম্ভব সুন্দর সূর্যাস্তের দৃশ্য আর আমাদের খুকি মা . কি এই খুকি মার্ ইতিহাস , আসুন জেনে নিন আমাদের বজ বজ কালীবাড়ির ইতিহাস
“খুকি মা”
আশ্বিন মাস শেষ হয়েছে। দুর্গাপূজা শেষ। কার্তিক মাস জানান দিচ্ছে, উত্তরের বাতাস ঠান্ডা ভাব। গঙ্গার ধারে গভীর হোগলার জঙ্গল। নিস্তব্ধ শ্মশান। আধপোড়া শব চুপিসারে টেনে নিয়ে যায় হিংস্র বন্য জন্তু। সেইখানে ধ্যানমগ্ন এক তান্ত্রিক, সিদ্ধপুরুষ দয়াল ঠাকুর। হঠাৎ তার ধ্যান ভঙ্গ হলো। একদল জোয়ান লোক মশালের আলোয় নৌকা পাড়ে এনে ভেরালো।তাদের কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল যে তাদের দলের সর্দার কেষ্ট পাত্র গুরুতর আহত এবং বাকিরাও ক্লান্ত-অবসন্ন। দয়াল ঠাকুরের বুঝতে অসুবিধা হল না যে এরা সব ডাকাত এবং কোন জায়গা থেকে ডাকাতি করে ফিরছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন, “বাবাজিদের কোথা হতে আগমন?”
ডাকাতরা জানায়, ” আসছি দামোদর বর্ধমান থেকে। যেতে হবে বহুদূর। সেই দক্ষিনে রামকেষ্টপুর”(বর্তমানে কাকদ্বীপের রামকৃষ্ণ নগর)। দয়াল ঠাকুর লক্ষ্য করলেন ডাকাতরা লুটের সমস্ত জিনিস ভাগবাটোয়ারা করতে ব্যস্ত। মশালের আলোয় সেই স্তুপ আকৃতির জিনিসের মধ্যে চকচক করছে কষ্টি পাথরের তৈরি একটি মূর্তি যা দয়াল ঠাকুরের চোখ এড়ালো না।তিনি যা বোঝার বুঝলেন কিন্তু ডাকাত দলকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললেন,”বাবাজীরা, এতদুর থেকে আসা হচ্ছে, সঙ্গে রাজরাজেশ্বরী মা ব্রহ্মময়ী এই বিগ্রহ। একে কি একটু জল তুলসী দেওয়া হয়েছে? নইলে যে বড় অকল্যাণ হবে!”তান্ত্রিকের কথা শুনে চমকে উঠলেন ডাকাত সর্দার। বললে,”ক্ষমা করো বাবা ঠাকুর। আমরা মহাপাতক। তস্কর এর দল। না বুঝে শুনে ওই বিগ্রহের অবমাননা করেছি বলে মনে হচ্ছে। আমাদের তুমি অমঙ্গল থেকে রক্ষা করো ভগবান।”দয়াল ঠাকুর বললেন,”বেশ, তবে এক কাজ করো বাবারা, এই বিগ্রহটি আমাকে দাও। আমি ওর অন্নজল আর সন্ধ্যারতির ব্যবস্থা করি।”সরদার বলল,”তাই করো বাবা ঠাকুর, আমরা আর ওই বিগ্রহ নিয়ে আর পাপ বাড়াতে চাইনা। এই মূর্তি তুমি রাখো।”সরদার অন্যান্য ডাকাতদের বলল,”ওরে শোন মাকে আর টানাহেঁচড়া করিসনি। আর সবকিছু গুছিয়ে নে।খালি ওই বিগ্রহ খান এই তান্ত্রিক ঠাকুরের কাছে থাকতে দে। এই হয়তো মায়ের ইচ্ছা। তিনি এখানেই থাকতে চান।”ভোরের আলো ফোটার আগে ডাকাতদল বিদায় নিল।
পরের অমাবস্যা তিথিতে ওই বেদীর ধারেই শ্মশানের পাশে একটি পুরনো বট গাছের নিচে পঞ্চমুন্ডির আসন পাতলেন দয়াল ঠাকুর। তার গুরুদেব স্বামী পূর্ণানন্দ কে দিয়ে স্থাপন করলেন সেই বিগ্রহ। গোলপাতার ছাউনি দিয়ে ঘেরা পর্ণকুটিরে শুরু হলো মা ব্রহ্মময়ীর পূজা।
আজ থেকে প্রায় 125 বছর আগের কথা। যদিও এগুলি জনশ্রুতি, ইতিহাস সিদ্ধ ব্যাখ্যা মেলে না কিন্তু ১৮৯২/৯৩ সালের এই ঘটনা গবেষকরা ব্যাখ্যা করেছেন।তাদের ধারণা এই বিগ্রহ আসলে বর্ধমান জেলার কালী সাধক কমলাকান্তের।কারণ কমলাকান্তের পূজিত বিগ্রহ সঙ্গে দয়াল ঠাকুরের বিগ্রহের অনেক মিল। হাতখানেক উচ্চতার এই মুহূর্তে একটি অখণ্ড কালো পাথর কেটে তৈরি, কোথাও কোন জোড়া লাগানো নেই। এমনকি গলার মুণ্ড মালাটিও ওই পাথর কেটে তৈরি।গবেষকরা মনে করেন এর যার নির্মাণ খরচ তার ব্যয়ভার বহন করা কোন রাজা মহারাজা নিদেন পক্ষে জমিদারের পক্ষে সম্ভব। সবথেকে উল্লেখযোগ্য এই যে, এই বিগ্রহের পায়ের নিচে মহাদেব শায়িত নেই। শোনা যায় কমলাকান্ত নিজের বুকের উপর ওই বিগ্রহ রেখে পূজা করতেন।১৮২১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর হঠাৎ একদিন মন্দির থেকে বিগ্রহটি উধাও হয়ে যায়।
বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭২-১৮২১) জন্মগ্রহণ করেন। এখানকার চান্না গ্রামে বিশালক্ষী মন্দির সাধনা করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। অত্যন্ত পন্ডিত মানুষ বলে তাকে “চক্রবর্তী” উপাধি দেওয়া হয়েছিল। বর্ধমানের মহারাজা তার গুনে এবং শাক্ত সংগীত শুনে তাকে সভাপতি নিযুক্ত করেন এবং অচিরেই তাকে “গুরুদেব” রূপে অভিষিক্ত করেন।গুরুদেবের সাধনার জন্য বর্ধমানের কোটাল হাটের কাছে একটি নির্জন জায়গায় ১২ কাঠা জমির উপর একটি মন্দির বানিয়ে দেন রাজা তেজচন্দ্র এবং এই মন্দিরে পূজার জন্য একটি কালো কষ্টি পাথরের মূর্তি তৈরি করে দেন বলে জানা যায়। মনে করা হয় কোটাল হাটের মন্দিরের সেই বিগ্রহটি পাকে প্রকারে বজবজের দয়াল ঠাকুরের হাতে এসে পৌঁছেছিল। আবার অনেকে বলেন দয়াল ঠাকুর বলেছেন তাঁর গুরুদেব স্বামী পূর্ণানন্দ বীরভূম বর্ধমানের দিক থেকে এই বিগ্রহটি তাঁকে এনে দেন।
মন্দির প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথমে দয়াল ঠাকুর নিজে মায়ের পুজো করতেন। কিন্তু তিনি দ্বিজ ছিলেন না। তথ্য অনুযায়ী ১৮৮৬ সাল নাগাদ বজ বজ বন্দর তৈরি হবার পর বীরভূম থেকে বজ বজে আসেন পোর্ট কমিশনের চাকরি নিয়ে। এখানে এসে বিষ্টু পাড়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কিছুদিন পর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি তন্ত্র উপাসনায় মন দেন।প্রথমদিকে মাটির তৈরি একটি ঘরে একটি মাটির কালী প্রতিমা পূজা করি চলছিল তার সাধনা ।স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে সিদ্ধপুরুষ বলেই মনে করত।এই সময় অধর দাস নামে এক ব্যক্তি যিনি কালী ভক্ত ছিলেন পূজার্চনার কাজে দয়াল ঠাকুরকে সাহায্য করতেন। পরবর্তীকালে বজ বজ কালীবাড়ি মন্দির গড়ে ওঠার পেছনে অধর দাসের অবদান অনস্বীকার্য।
এরপর এক নতুন পুরোহিতের আগমন হয়। বলা হয় তিনিই বজ বজ কালীমন্দিরের প্রথম পুরোহিত। রামজী মহারাজ বা কালিকানন্দ স্বামী। শোনা যায়, আদতে তিনি ছিলেন অযোধ্যার বাসিন্দা। পূর্বে তার নাম ছিল বলভদ্র পান্ডে। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর হাবিলদার। পরে কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে যান। বজ বজ কালীবাড়ি তে এসে মা ব্রহ্মময়ী কে তিনি আদর করে “খোকী মাঈ” বলে ডাকতেন। সেই থেকে “খুকি মা” নামটি পরিচিত হয়েছে।
বর্তমান কালীবাড়ি টি নির্মিত হয় বাংলার ১৩৪৩ সাল(ইংরেজি ১৯৩৬ সন) নাগাদ।বারান্দা সমেত উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট একটি মোজাইক করা সুন্দর মন্দির নির্মাণ করে দেন বজ বজ এর বিশিষ্ট বাসিন্দা আশুতোষ এর স্ত্রী পূর্ণকাশী দেবী।অধর দাস নির্মিত মন্দির দালান ঘরকে ভিতরে রেখে এই নতুন দালান মন্দির তৈরি হয়। নতুন মন্দির তৈরি করা হয়েছিল খানিকটা পূর্ব দিক ঘেঁষে। সেই সময়ে মন্দির কমিটিই ভেবেছিলেন নির্মাণ শেষ হলে মূর্তি সরিয়ে মন্দিরের মধ্যস্থলে বসানো হবে। কিন্তু পুরোহিতরা বলেন পঞ্চমুন্ডির আসন একবার বসানো হলে তার স্থানান্তরিত করা যায় না। ফলে শেষ পর্যন্ত ওই আসন আর সরানো হয়নি। তাই আজও দেখা যায় ব্রহ্মময়ীর মূর্তিটি ঠিক প্রধান দরজার সোজাসুজি বসানো নেই।
মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দির টি ঠিক কবে নাগাদ তৈরি হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না।তবে অবশ্যই ভক্তবৃন্দের উদ্যোগে ও ভক্তিতে এটি নির্মিত হয়।ভক্তদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও বদ্যানতায় এর আশেপাশে আরো কত গুলি দেবালয় নির্মিত হয়। দেবদেবীর দেশ ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র একটি জনপল্লীতে এরা আছেন সবাই পাশাপাশি। এই দেবালয় গুলির মধ্যে প্রাচীন গোপাল মন্দির। যেমন আছেন জগন্নাথ, বলরাম , সুভদ্রা তেমনি দেবী মনসার আসন ও আছে। এর ঠিক সামনে পাথরে তৈরি দোল বেদী,সূর্যদেবকে মাঝখানে রেখে সামনে শনি ঠাকুর ও অন্যান্য গ্রহদের আলাদা আলাদা সাজিয়ে পূজা করা হয়ে থাকে। লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির ও হনুমান মন্দির খুব পুরোনো নয়, বলা যায় হাল আমলের। এবারে খানিকটা বাইরে উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে শীতলা মন্দির। এর পেছনের রেলিং ঘেরা বেদীতে পঞ্চানন্দ ঠাকুরের স্থান। বজ বজ পুরসভার একটি নথি থেকে জানা যায় ১৯৫১-৫২সাল নাগাদ স্থানীয় রিকশাচালকদের চেষ্টাতেও এই বেদি নির্মাণ হয়েছিল। মূল মন্দিরের বাঁদিকে রয়েছে রাস মঞ্চ। সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা সেখানে রাসের সময় রাস মঞ্চ বাধা হয়। রাসমঞ্চ এর রাধা কৃষ্ণ মন্দিরের এক পাশে রয়েছে একটি নবনির্মিত গণেশ মন্দির। মূল মন্দিরের ডান দিকে এলে একটি প্রাচীন বট ডালপালা বিস্তৃত করে আছে। এই গাছের নিচে লাল রঙের শঙ্কু আকৃতির তিনটি উঁচু বেদী।এই বেদি তিনটিতে পাথরের ফলকে লেখা নাম ৩ মহাত্মার স্মৃতি বহন করে। এনারা হলেন কালিবাড়ি মন্দিরের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা দয়াল ঠাকুর, প্রথম পুরোহিত রামজী মহারাজ এবং স্বামী পূর্ণানন্দ। এর ডান দিকে শিব মন্দির। অন্যদিকে সাবিত্রী সত্যবান এর বিগ্রহ।
কালীবাড়িতে আছি সেগুন কাঠের একটি রথ। উচ্চতা প্রায় কুড়ি বাইশ ফুট। বজবজের একটি পুরানো বাসিন্দা জগন্নাথ দাস এর বাড়িতে এটি এক সময় থাকতো। ভগ্নদশায় রথ টিকে উদ্ধার করা হয় এবং সংস্কার করে কালীবাড়িতে রাখা হয়। প্রতিবছর রথযাত্রায় এই রথের রশিতে টান পড়ে। কালী বাড়ির পেছনে আজও আছে সেই শ্মশান। বর্তমানে এটিকে অনেক উন্নত করা হয়েছে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) তার "ধাত্রীদেবতা" উপন্যাসটিতে গোঁসাই বাবার কথা বলেছেন। লেখক বলেন ধাত্রীদেবতা তার আত্মজীবনী এবং গোঁসাই বাবা রামজী মহারাজ।২৯/০৭/১৯৬৪ সালে একটি পত্রে তিনি লেখেন," রামজি সাধু আমার গোঁসাই বাবা-আমার জন্ম কাল থেকে কৈশোরে এমনকি যৌবনের প্রারম্ভে পর্যন্ত একটি বিশেষ স্থান জুড়ে আছেন। শুনেছি-আমি যখন মাতৃগর্ভে তখন তিনি আমার কল্যাণ কামনায় যজ্ঞ করেছিলেন, জপ করেছিলেন। আমার "ধাত্রীদেবতা" উপন্যাসে তিনিই গোঁসাই বাবা। এই গোঁসাই বাবা বা রাম জী সাধুর একটি আস্তানা ছিল বজবজে। মাঝেমধ্যে বজ বজে এসে থাকতেন তিনি। তার এক ভক্ত ছিল। তার নাম অধর দাস। গঙ্গার ধারে একটি বটগাছের তলায় তিনি একটি কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই কালির নাম দিয়েছিলেন "খুকি মা"। ১৯১৬-১৭ সালে আমি কলকাতায় পড়তে এসে বজ বজে এসেছিলাম। খুকি মা তখন বটগাছের তলায় একটি বেদীর উপর ছিলেন। সুদীর্ঘকাল পর কলকাতায় এসে তখন বাস করছি। তখন একদিন বজ বজে গিয়েছিলাম। অতীত স্মৃতির আকর্ষণে। গোঁসাই বাবা এখনো আমার মনের মধ্যে আছেন। মুছে যান নি। জীবনে যারা অক্ষয় স্থানের অধিকারী তিনি তাদের অন্যতম। বজবজের প্রতি একটি আকর্ষণের সেই সূত্র। বজ বজ আজ ১৯২৬-১৭ সালের বজ বজ নেই। আজ বজ বজ একটি সমৃদ্ধ স্থান। খুকিমা আজ বটতলার অধিকারিনী নন।আজও পর্যন্ত যান্ত্রিক সভ্যতার মধ্যে আধ্যাত্মবাদের মত প্রাণকেন্দ্রে জাগ্রত রয়েছেন।ভারত সভ্যতার বিবর্তনের রূপটিকে অবিকৃত রেখেছেন।"
মাতৃ সংঘ জনকল্যাণ আশ্রম এর প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত কালীভক্ত তন্ত্রসাধক প্রয়াতঃ সুদীন কুমার মিত্র (১৯১৯-১৯৮৪) তিনি বজ বজের এই শ্মশানে বসেই তন্ত্র সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। ("জন্মভূমি" লেখক, তিনি নিজেই এই তথ্য দিয়ে যান)।
মায়ের অপার করুণায় বয়ে চলেছে কালস্রোত। শুধুমাত্র বজবজবাসী নয়। আপামর ভক্তবৃন্দ কোনদিন বঞ্চিত হয়নি মায়ের অসীম কৃপা থেকে।কত গল্প গাথা, স্মৃতিকথা এই মন্দিরকে ঘিরে, কোনোটা লৌকিক, কোনোটা অলৌকিক, ইতিহাস কে সাক্ষী রেখে আজও অম্লান অতি প্রাচীন জনপদের এই অতি প্রাচীন "বজ বজ চিত্রগঞ্জ শ্রী শ্রী কালীবাড়ি"। জয় মা ব্রহ্মময়ী, জয় খুকি মা।
Image Sources: আমাদের বজবজ FB group, Content: নিশিত সাহিত্যপত্র সেপ্টেম্বর ২০১৭