আমাদের বজবজের ইতিহাস
আমাদের একটি ছোট প্রয়াস সবার সামনে আমাদের বজবজের ইতিহাস তুলে ধরার.
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জীবিকার দিকে সামান্যতম নজর দিলে দেখা যাবে এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিকার্যের সঙ্গে যুক্ত। সেই কৃষিপ্রধান জেলার মধ্যে অবস্থিত বজবজ অঞ্চলের মানুষের মূল জীবিকা হল মূলত এলাকার বৃহৎ ও মাঝারি ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্ভর এবং শিল্পঞ্চল রূপে গণ্য হবার কারণে জীবিকার তাগিদে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বহিরাগত মানুষ এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। কালের প্রবাহে সকলে মিলে এক মিশ্র সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এ পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের পাতাতে হালকা তল্লাশি চালালেই জানা যায় ঐতিহাসিকভাবে অতীতের একটি সামরিক কেন্দ্র (এখানে বজবজ দুর্গের কথা বলা হচ্ছে) পরবর্তীকালে শিল্পাঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ঐতিহাসিকভাবেই বজবজ কত পুরনো সে বিষয়ে কোনো শক্তিশালী নথিপত্র নেই। প্রাপ্ত গবেষণা মতে এই জনপদের অধিকাংশ অঞ্চলে ছিল বনজঙ্গলে ভরপুর। আমার ধারণা তা সুন্দরবনেরই অংশ ছিল।(যেহেতু দক্ষিণ রায়ের পুজো সাড়ম্বরে হত এই অঞ্চলে বাঘের প্রকোপও ছিল) আদিগঙ্গা মজতে শুরু করলে কলকাতার দক্ষিনে মেটিয়াবুরুজ আকড়া নঙ্গী বজবজ প্রভৃতি স্থানে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে উঠতে লাগলো। নদীর পলি মাটিতে চাষ বাসের সুযোগ কে ছাড়বে! শুরু হল জঙ্গল সাফাই অভিযান। এরকম জঙ্গল কেটে যারা প্রথম বসবাস শুরু করেন তাদের মধ্যে সারেঙ্গাবাদ এবং বজবজের হালদাররা। জানা যায় তারা বজবজ দুর্গে হাবিলদারের কাজ করতেন।
“হাবিলদার” এর ধ্বনি বিপর্যয় এর মাধ্যমে “হালদার” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে একথা সহজেই অনুমেয়। বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে তারা বাস করতে শুরু করেন এবং জঙ্গল কাটা স্থান গুলির মালিক জমিদার তারা ই হন। বজবজের পাঁজালরা তাদের সমসাময়িক বা কিছুকাল পরে আসেন। তারপর আসেন ঘোষেরা। হালদার, পাঁজাল বা ঘোষেদের আগে বজবজ যে বসতি শূন্য ছিল তা নয়। নদী তীরবর্তী বলে এখানে কৃষক, কুমোর শ্রেণীর কিছু কিছু লোক বাস করত।ইংরেজ আমলে নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কুমোরদের হটিয়ে পরবর্তীকালে এখানে তেল কোম্পানি তাদের বড় বড় পেট্রোল ট্যাংক নির্মাণ করতে থাকেন।
“বজবজ দেখা যায়, এই মুসলমান বাড়ি তো তার পাশেই হিন্দুদের বাড়ি, একপ্রান্তে দক্ষিণ রায়ের থান, তো অপর প্রান্তে পীরের মাজার।খানে মসজিদ তো খানিক দূরেই শিব মন্দির।”
আজ পর্যন্ত যত অনুসন্ধান হয়েছে তা থেকে জানা যায় লিখিত ইতিহাসে ১৭৫৬ সালের আগে বজবজের নাম পাওয়া যায়নি। বজবজ এর নাম উল্লেখ আছে এরকম অন্যতম প্রাচীন নথি “Indoston” এর লেখক Robert Warm লিখেছেন, ” ২৫ শে জুন (১৭৫৬) তারা কলকাতার ২০ মাইল নিচে বজবজ পার হবার সময় দেখল দুর্গটি শত্রুসৈন্য তারা সবেমাত্র কামান দিয়ে সাজানো হচ্ছে।” বজ বজ এর নাম F.C. Hill এবং Arthur Bruce এর ও রচিত গ্রন্থে পাওয়া গেছে ওই একই ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে।
তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের “পলাশীর যুদ্ধ” গ্রন্থ থেকে জানা যায় ক্লাইভ এবং ওয়াটসন সৈন্য বাহিনী নিয়ে নৌবহরে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বপ্রথম বজবজের দক্ষিণ দিকে মায়াপুর গ্রামে পদার্পণ করেন এবং সেই গ্রামের অধিবাসীদের সাহায্যে খাদ্যের ও রত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়।
হাওড়া জেলার সেনসাস হ্যান্ড বুকে (১৯৬১) হুগলি নদীতীরবর্তী স্থান গুলির প্রাচীন ইতিহাস প্রসঙ্গে এক স্থানে বলা হয়েছে, ” হুগলি নদীর কূলে অবস্থিত গ্রামগুলি বজবজ পর্যন্ত মগ পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা প্রায়ই আক্রান্ত হত।” বাংলায় এই মগ জলদস্যুদের উপদ্রবের ইতিহাস সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত গ্রামগুলিকে লুট করতো এবং নর-নারী থেকে শিশু সকলকেই দাসে পরিণত করত। সুধীর কুমার মিত্র তার “হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ” প্রথম খন্ডে লিখছেন, “সুন্দরবন ও বজবজ আঞ্চলিক পর্তুগিজ ক্রীতদাসবাহী জাহাজগুলির সর্বপ্রধান আড্ডা ছিল।”
বারো ভূইয়ার অন্যতম নায়ক প্রতাপাদিত্য মগ জলদস্যুদের প্রতিহত করার জন্য বজবজে দুর্গ স্থাপন করেছিলেন।পরবর্তীকালে শাহজাহান এই দুর্গের সংস্কার করে এখানে ঘোড়া হাতি সহ প্রায় ২২০০ সেনা থাকার বন্দোবস্ত করেন।প্রতাপাদিত্যের আমল থেকেই দুর্গের উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে জনবসতি তৈরি হচ্ছিল। শাহজাহানের সময় থেকে মুসলিমদের আগমন ঘটলো।হিন্দুরাও কিছু এল হাওড়ার দক্ষিণ অংশ থেকে । এই প্রবাহমানতা প্রায় কুড়ি বছর ধরে চলে। যেসব হিন্দু মুসলমান বাইরে থেকে এসেছিল তারা মূলত দুর্গ পূনর্গঠনের শ্রমিক ছিল। এই সমীক্ষাটি দুর্গের পরিখার বাইরে প্রায় পাশাপাশি বাসা বেঁধে থাকত।এখানকার চাষযোগ্য জমি, মাছভর্তি নদী-নালা প্রভৃতি অনুকূল পরিবেশের জন্য অনেকেই তাদের মূল বাসস্থানে আর ফিরে যাননি। বজবজ দেখা যায়, এই মুসলমান বাড়ি তো তার পাশেই হিন্দুদের বাড়ি, একপ্রান্তে দক্ষিণ রায়ের থান, তো অপর প্রান্তে পীরের মাজার। এখানে মসজিদ তো খানিক দূরেই শিব মন্দির। মূলত, শ্রমিকশ্রেণীর সহজাত অবস্থান এহেন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা তৈরিতে সর্বাগ্রে সহায়তা করেছে। যাইহোক, শিল্পাঞ্চল থেকে অনতিদূরে একটা জলাভূমিতে মানিক চাঁদের নেতৃত্বে সিরাজবাহিনী এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনার সঙ্গে একটি গড়পেটা যুদ্ধ হয়েছিল। যখন সিরাজ বাহিনীর জয় নিশ্চিত হচ্ছিল হঠাৎ মানিকচাঁদ নির্দেশ দেন- চল মুর্শিদাবাদ! সেনা তারপর মুর্শিদাবাদের দিকে ফিরে চলল।ক্লাইভের পর দুর্গ অধিকার করে কামান দেগে ধ্বংস করে দেন এবং তারপর অরক্ষিত কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন। এই যুদ্ধে তৎকালীন সময়ের বজবজ অধিবাসীদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।
শাহজাহানের দুর্গ সংস্কারের ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। ১) কলকাতা থেকে দুর্গে যাবার জন্য একটি ভাল রাস্তা তৈরি হয়েছিল। ২) চড়ামাদার গ্রামের খেয়াঘাটে একটি কোতোয়ালি তৈরি হয়েছিল।বর্তমানে এই রাস্তার নাম মহাত্মা গান্ধী রোড বজবজ ট্রাঙ্ক রোড। এই রাস্তাই উলুবেরিয়া হয়ে মেদিনীপুর ওড়িশা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়িতে যাতায়াতের পথ হিসেবে বিস্তৃত হয়েছিল। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় ওড়িয়াদের কলকাতা আগমন মূলত এই পথেই। সেই সূত্রে এর নাম হয়ে গিয়েছিল “কটক রোড”। চড়ামাদারের এর আশেপাশে অবস্থিত জনপদগুলো ওইখানকার গ্রামে দক্ষিণ রায়ের একটি থান প্রতিষ্ঠা করে পুজোর প্রচলন করেছিল। ১৭৭৬-৭৭ নাগাদ চীনদেশীয় ব্যবসায়ী টং মিন অছি ( অছু)সামুদ্রিক ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে এরকম চড়ামাদারে এসে পৌঁছাল তখন গ্রামবাসীদের কাছে সে আশ্রয় পেয়েছিল। বাংলায় তখন হেস্টিংস এর শাসনকাল। অছু কোম্পানির কাছে দরখাস্ত পাঠাল ব্যবসা এবং চাষবাসের জন্য ৩০০ বিঘা জমির জন্য(১৭৭৮, ১৯ শে জুন) । এরপর আছু দেশে ফিরে গিয়েছিল। বছর তিনেক পরে এদেশে তিনি ১১০ জন চিনা কে নিয়ে এসেছিল। কোম্পানি তখন বাৎসরিক ৪৫ টাকা খাজনার বিনিময়ে ৩০০ বিঘার পরিবর্তে ৬৫০ বিঘা জায়গা বর্ধমান রাজার থেকে পাট্টা বন্দোবস্ত করে দিল। চীনা শ্রমিক ছাড়াও আছো দুটি বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে এসেছিল। এই আরো দেবদেবীর মূর্তি কোথায় স্থাপন করবে? তখন স্থানীয় অধিবাসীরা দক্ষিণ রায়ের দেবস্থানেই মূর্তি দুটির প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে দিল। এখানে চেনা উপনিবেশ আর বাংলার প্রথম পরিকল্পিত তথা সংঘটিত শিল্প প্রতিষ্ঠান অছু সাহেবের চিনি তৈরীর কারখানা স্থাপিত হলো ১৭৮০ তে। বর্তমানে এই জায়গার নাম চিনেমান তলা। আছুর নাম অনুসারে ওই জায়গার নাম আছিপুর
অছুর কারখানার জন্য প্রচুর পরিমাণে চিনি রাখার কলসি এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দরকার হওয়াতে নদীর ধারে গড়ে উঠল পালপাড়া। নিবিড় আখ চাষের সরঞ্জামের জন্য গড়ে উঠল কামারশাল। চৈনিক দেব দেবীর আরাধনার জন্য গড়ে উঠল একটি ছোট্ট চিনা মন্দির তৈরি হল কতোয়ালি, ডাক ব্যবস্থা।১৭৮৩ সালে অছুর মৃত্যুর পর বছর অছুর মেয়ে কারখানা চালাতে না পারায় ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চেনা উপনিবেশ ভেঙে কলকাতায় চলে যায়। প্রতিবছর চীনাদের নববর্ষ উপলক্ষে চীনেমানতলার মন্দিরে এক মাস ব্যাপী উৎসব হয়(জানুয়ারির শেষ দিকে ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধ পর্যন্ত) ১৮৫১ সালে ২৪ পরগনা যখন আলিপুর ও বারাসাত এই দুই বিভাগে বিভক্ত ছিল তখন আলিপুরের ১৫ টি থানার মধ্যে আছিপুর ছিল একটি। বজ বজ তখন আছিপুর থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৯১ সালের সেন্সাস এ দেখা যায় থানা আছিপুর থেকে বজবজে স্থানান্তরিত হয়। আগে পোস্ট অফিস ছিল আছিপুরে। বজবজ ছিল কেবল ডাকচৌকি। আছুর সময়কালের বেশ কিছু পরে ১৮৭৩ এ বজবজ দুর্গের ধ্বংসাবশেষ এর জায়গায় অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানির জুটমিল বসলো। তখন থেকে আচিপুর এর গুরুত্ব কমতে শুরু করলো। হাওড়া হুগলি মেদিনীপুর জেলা এবং স্থানীয় এলাকার কৃষিজীবী মানুষেরা ক্রমে শ্রমিকে পরিণত হতে শুরু করল। নগরায়ন শুরু হলো রেলপথ বিছানো শুরু হল। ইতিমধ্যে বাওয়ালি অঞ্চলে মন্ডল জমিদারদের আবির্ভাব ঘটেছে। এনাদের পূর্বপুরুষ বাস করতেন হিজলিতে। কৃষিজাত ব্যবসায় এত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল যে উত্তর-পূর্বদিকে চেতলা থেকে শুরু করে দক্ষিনে ক্যানিং পর্যন্ত এনাদের জমিদারিত্ব প্রসার লাভ করেছিল।প্রথমে এনারা শাক্ত ছিলেন পরে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বজ বজ জুটমিলের পাশেই বজ বজ দুর্গের ধ্বংসাবশেষ এর উত্তর দিকে বিভিন্ন জ্বালানি তেল ও কেরোসিনের সঞ্চয় ডিপো তৈরি হলো। ১৯১৯ এ বজ বজ শিল্পাঞ্চলের অনতিদূরে বিড়লা দের প্রথম জুটমিল তৈরি হলো। সেই সময় এই অঞ্চলের মোট জুটমিলের সংখ্যা ছিল ৭। ক্রমাগত শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশদের সহায়তায় তৈরি হলো বজবজ পৌরসভা(১৯০০)।স্থানীয় মানুষ এবং বহিরাগতদের নিয়ে গড়ে উঠতে শুরু করল ঘনবসতি এবং সময়োপযোগী সংস্কৃতির বিকাশ। এর পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলী-যেমন, স্বামী বিবেকানন্দের বজবজে অবতরণ, কোমাগাতামারু হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ঘটনা কমবেশি প্রায় সবাই জানে। সেসব ঘটনা নিয়ে সবিস্তারে পরে আবার আলোচনা হবে। এটা সূচনা মাত্র।
— তথ্য সূত্র: নুকুড় চন্দ্র মিত্র, বিমল পণ্ডিত, মোহন নস্কর, ইন্টারনেট–