চিনি ,চা , চিনা ১

আজ শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস শুনব আমাদের এলাকা নিয়ে ।বিক্রমশীল মহাবিহারের আচার্য্য অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান ১০৪০ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে তিব্বত যাত্রা করলেন।১০৪১ সাল তিনি নেপালে কাটান।নেপাল রাজের আতিথেয়তা গ্রহণ করে হোল্কা, পাল্পা পেরিয়ে, দস্যু উৎপীড়ক এর বাধা কাটিয়ে তিনি পৌঁছলেন নেপাল-তিব্বত সীমান্তের মন-ইফল গুন্থান।তাঁর সাথে ছিলেন বিক্রমশীল মহাবিহারের সাথী বিশিষ্ট তিব্বতি ভিক্ষু ও অনুবাদক ছুল ক্রিম জলবা (শরদিন্দুর লেখনীতে টুট খ্রীম গ্যাম্বলা) বা আচার্য বিনয়ধর এবং আরও কিছু সংগীসাথি।এই মন-ইফুল গুন্থানে এসে দেখা মিলল তিব্বত রাজ চ্যাংচুর গুগে রাজ্যের সৈন্য দলের যারা এসেছিলেন রাজ অতিথি অতীশ কে নিয়ে যেতে। এই দলে ছিলেন সেনাপতি লা-ওয়াং পো ও রাজপ্রতিনিধি নারি-চো-সুমপা।
রাত্রি যাপনের জন্য তাঁবু ফেলা হল। চারিদিকে শীতার্ত পরিবেশ।এরই মধ্যে নারি-চো-সুমপা ড্রাগন আঁকা এক পাত্রে এক পানীয় এনে অতীশকে জানালেন যে এই পানীয় তিব্বত দেশের স্বর্গীয় পানীয়। স্থানীয় ভাষায় কল্প বৃক্ষের নির্যাস। এও জানালেন,যে গুল্মের পাতা থেকে এই পানীয় প্রস্তুত, তার ছাল খাওয়া যায় না।কিন্তু এই গুল্মের পাতা গুঁড়া করে গরম জলে সিদ্ধ করে পান করাই নিয়ম। সামান্য নুন আর মাখনও দেওয়া যায়। এর গুণ অনেক। কৌতূহলী অতীশ প্রশ্ন করলেন, “এই পানীয়ের নাম কী?” উপস্থিত সকল তিব্বতীরা এক সাথে উত্তর দিলেন,”প্রভু! এর নাম চা।”
অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান অতঃপর প্রথম ভারতীয় ও বাঙালী রূপে Crush Tear Curl চা পান করলেন। এবং বাংলায় প্রথম চা উনিই পাঠিয়েছিলেন।
সিনেমার ভাষায় জাম্পকাট করে আমরা কয়েকশ বছর এগিয়ে যাই।অষ্টাদশ শতাব্দী, ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়কাল। বজবজের উপকন্ঠে কিছু সাথী নিয়ে নোঙর করলেন জনৈক চিনা চা ব্যবসায়ী ইয়াং দাজো ওরফে ইয়াং তাই চাও অথবা ব্রিটিশ সরকারের ভাষায় তাং আচিউ।
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভাল তখনও আসাম বা দার্জিলিং চা উৎপাদন হওয়া শুরু হয়নি।( আসাম চা আবিষ্কার করেছিলেন ১৮২৩ সালে রবার্ট ব্রুস আর ১৮৪১ সালে সিভিল সার্জেন আর্চিবল্ড ক্যাম্পবেলের সময় দার্জিলিং এ চা চাষ শুরু হয়)।
খুব বেশী তথ্য নেই এই ইয়াং তা চাও বা তাং আচিউ সম্পর্কে। যা আছে তা বেশীরভাগই গল্পগাছা আর কিংবদন্তীর মিশেলে গড়া আবছা অবয়বের মতন।
কথিত আছে তাং আচিউ বজবজে চিনিকল খুলতে চেয়ে ১৭৭৮ সালে বাংলার সরকারের কাছে জমি চেয়েছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস নাকি তার আনা চা পান করে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁকে ৬৫০ বিঘা জমি বার্ষিক ৪৫ টাকায় দিয়েছিলেন। 
আসল কারণ ছিল বোধহয় পুরোটাই ব্যবসায়িক। চীনের কিং রাজতন্ত্রে তখন ইউরোপীয়দের সন্দেহের চোখে দেখা হত। ব্যবসায়ীদের প্রবেশাধিকার ছিল না।কিন্তু আজকের মতন চীন সেদিনও ছিল এক বৃহৎ বাজার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে সম্ভব ছিল না একে উপেক্ষা করার। স্কটিশ অভিযাত্রী ও কূটনীতিক জর্জ বগল এর মাধ্যমে তখন হেস্টিংস তিব্বত ও চীনের সাথে বাণিজ্যের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সময়ে এক চিনা ব্যবসায়ীকে জমি ও ব্যবসার অনুমতি দিয়ে তিনি নিশ্চিত ভাবেই এক ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক চাল দিয়েছিলেন। 
সে যাই হোক, জমি পেয়ে তাং আচিউ শুরু করলেন আখ চাষ আর তার সাথে চিনি কল। সাথে নিয়ে এলেন চীনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কর্মীদের। শুরু হল ভারতের প্রথম চীনা উপনিবেশ বা চিনেম্যানতলা আর তাং আচিউ এর নামের স্থানীয়করণ হয়ে জায়গার নাম হল আজকের অছিপুর।
তাং আচিউ এর কাল অবশ্য বেশী প্রলম্বিত হয় নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নথি অনুসারে ১৭৮৩ সালের মধ্যেই তার মৃত্যু হয় আর তার বছর দশেক পরেই বন্ধ হয়ে যায় চিনিকল।সেখানকার চিনা অধিবাসীরা কালক্রমে চলে আসেন কলকাতায় এবং ক্রমশ জমে ওঠে বেন্টিক স্ট্রিট, বউবাজার আর টিরেটা বাজারের চিনা বসতি।
তারাতলা রোড বা বেহালা চৌরাস্তার বীরেন রায় রোড ধরে বজবজ ট্রাংক রোড হয়ে মহেশতলা, নুংগি, বজবজ পেরিয়ে, হুগলীর পাশে গড়ে ওঠা অধুনা মহীরুহ আবাসন প্রকল্প ও সিইএসসির বজবজ প্ল্যান্ট কে ডানদিকে রেখে পৌঁছে যান অছিপুর ফেরীঘাট। অছিপুর ফেরীঘাটের পাশেই পুজালী পুরসভার গেস্ট হাউস ।ফেরীঘাটের আগেই বাঁ দিকে এক রাস্তা চলে গেছে বটতলা থেকে চিনেম্যানতলা। সেই চিনেম্যানতলাতেই অবিকল ইস্টবেঙ্গল পতাকার রঙে সেজে ওঠা চিনা উপাসনা স্থল।  মুশকিল হল সবদিন এই মন্দির খোলে না। মন্দির সেজে ওঠে চীনা নববর্ষের দিন ও তার পরের রবিবারে। এই মন্দির পরিচালিত হয় ব্ল্যাকবার্ন লেন বউবাজার থেকে। এই মন্দিরেই পূজিত হন আচিউ এর নিয়ে আসা দেবমূর্তি খুদা খুদি। মজার ব্যাপার একই সাথে মন্দিরে ফুলমালা নৈবেদ্য পান দক্ষিণরায় আর বনবিবি ও। 
খুদাখুদির মন্দির থেকে আরও এগিয়ে ২ কিমি মত এগিয়ে গেলে আবার সামনে হুগলীর প্রসস্থ বিস্তারের দেখা মেলে। নদীকে ডান দিকে রেখে ঢালাই রাস্তা ধরে এগোতে পাওয়া যাবে অছিপুরের বিখ্যাত ইঁটভাটা আর সেই ইঁটভাটার মাঝে এক খাঁড়ির ধারে শায়িত লাল টকটকে অর্ধবৃত্তাকার তাং আচিউ এর সমাধি। ২৩০ বছর আগের পূর্বসূরীকে প্রনাম জানাতে মাঝে মাঝে ধূপ ধুনো দিতে মাঝে মাঝে আসেন কলকাতার চীনারা। সেই পুড়ে যাওয়া ছাইএর দেখা মিলল। বাকী সময় খোলা আকাশের নীচে শায়িত তাং আচিউ আর সেই সমাধির প্রহরীর মত দেখা গেল চক্রাকারে উড়ে বেড়ানো বিশালাকার সামুদ্রিক চিলেদের যূথকে। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসার সময় এটুকুই বললাম, ঘুমাও তাং আচিউ, আমরা বিস্মৃত জাতি, তাই চিলেদের প্রহরায় ঘুমাও তুমি। 
সেই সমাধি স্থল থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে যেখানে এক সময় ছিল সেই চিনিকল আজ এক দিগন্ত প্রসারিত কাশবন। সে এক অপরূপ সৌন্দর্য্য। মেঘ আর কাশ একসাথে বিলীন নীল দিগন্তের মাঝে। 
বহুক্ষন চেয়ে থাকা যায়। 
কিন্তু যেতে হল। কারণ অনেক অবহেলার বারুদ বুকে জমিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এক বারুদঘর, শুনতে হবে যে তার কথাও।
(চলবে)
 
তথ্যসূত্রঃ
১.”নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা”- সন্মাত্রনন্দ(ধানসিঁড়ি) 
২. অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান -অলকা চট্টোপাধ্যায় (অনুষ্টুপ)
৩.দার্জিলিং এবং শাংগ্রিলার খোঁজে-পরিমল ভট্টাচার্য (অবভাস)
৪.Rangan Dutta Blogs
৫. আনন্দবাজার পত্রিকা -রবিবাসরীয় -শিশির রায়।
 

আন্তরিক ধন্যবাদ

রোজি সিং

Senior writer

Ankan Das

The Bhraman Production

error: No No No!! Cannot right click